তক্ষক (লেখকঃ হাসান মোরশেদ)

4 Comments

১। আইপডটা কানে গুঁজে দেবো কিনা ভাবছি। নিতান্ত অভদ্রতা হয়ে যায়, কিন্তু কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিনা। বয়স্ক ভদ্রলোক একটানা কথা বলে যাচ্ছেন। কথা বলা শুরু করেছেন অন্ততঃঘন্টা খানেক। আমি কিছুটা বিস্মিত ও হচ্ছি বটে। এই শীর্নশরীরের প্রায় বৃদ্ধ মানুষটা এতো কথা বলার শক্তি পাচ্ছেন কি করে?

যাচ্ছি ট্রেনে। এক জেলা শহরে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে। সুন্দর রোদেলা দিন। ট্রেনে ভীড় কম। জানালার পাশে বসেছি। পাশের সীট খালি ছিলো। চমৎকার বাতাস। আইপডে লোপামুদ্রার গান। উপভোগ করছিলাম।

প্রতীতির কথা মনে পড়ছিলো। পড়শু ডেটিং হলো আসিফের ফ্ল্যাটে। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। গল্প এখন শেষ পর্যায়ে। আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই,ছিলো ও না কোনোদিন। তবু হয়তো আমার মনে পড়বে প্রতীতিকে, প্রতীতির ও আমাকে মনে পড়বে কোনো অবসরে।
প্রতিবার ডেটিংয়েই প্রতীতি আমাকে শরীর দেয় আর দেয় এক একটা চমৎকার কবিতার বই। ও মেয়ে নিজে কবিতা টবিতা পড়েনা কিন্তু আমাকে পড়ায়। সম্পর্ক হওয়ার আগে কোন একদিন বোধ করি ওকে জানিয়েছিলাম আমি, কবিতায় আমার প্রেমের কথা। আমার অনেক কিছুতেই পরে ও আর বিশ্বাস রাখেনি, কিন্তু এই অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারটা মনে গেঁথে রেখেছে।

ব্যাগ খুলে কবিতার বইটা বের করি। জয় গোস্বামীর কবিতা সংগ্রহ। আমি জয়ের কবিতার তেমন ভক্ত নেই। বড্ড বেশী লিরিক্যাল। তবু এই ছুটেচলা রোদেলা দুপুর, প্রায় নির্জন রেলের কামরা, হুহু বাতাস- আমি প্রতীতির প্রতি প্রেম ও কবিতার প্রতি কামবোধে আক্রান্ত হই।

আইপড খুলে গলায় ঝুলিয়ে রাখি। বিশ্রাম নাও লোপামুদ্রা। ইতঃস্তত পাতা উল্টাই। বিন্যস্ত অক্ষর ও ছন্দের সমাবেশ। একটা পাতায় চোখ আটকায়ঃ

'একফোঁটা রক্ত শুধু ঝরে পড়ল,মাটি ফেটে গেলো আঘাতে? শিশুদের মরামুখ ভেসে উঠল কি একবার? তা কেউ দেখেনি,বড় মেঘ করে এসেছিল। নইলে দেখা যেত এই ফাঁকা
খেয়াঘাটে চাঁদ চেপে ধরে আছে রক্তে ভেসে যাওয়া নাড়ী তার।'

কেমন যেনো লাইনগুলো ।অকারনে আমার গা কেঁপে উঠে।

২। 'দেখলেন ঘটনা। এইবার কিন্তু খেলা জমবো। সব চোর ধরা পড়তেছে'

ভদ্রলোক আবার কথা শুরু করেছেন। তার কোলের উপর কটকটে হলুদ রংয়ের খবরের কাগজ। এই আরেক আপদ শুরু হয়েছে আজকাল। ত্রানের টিন,রিলিফের কম্বল,ঘুষের টাকা,তেরশো নদী,ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল গিলে খেয়ে ধরা পড়ছে বন কর্মকর্তা,পুলিশের দ্বিতীয়কর্তা,রানীমাতার জৈষ্ঠ্য সন্তান। আর এইসব নিয়ে সিনেমা সিনেমা গল্প জুড়ে দেয়া চায়ের টেবিল থেকে ট্রেনের কামরা পর্যন্ত। বিরক্ত লাগে। যন্ত্রনাময় দিনকাল।

-'আল্লাহর রহমত ছিলো, তাই দেশটা বেঁচে গেলো। আগামী ২০ বছর সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় থাকা দরকার,কি বলেন?'

আমি মনে মনে গালি দেই। 'মর্ষকামী ভোদাই পাবলিক'। এই সব পাবলিকের কারনেই হাঁটুতে ঘিলুওয়ালারা ছড়ি ঘোরায়। যখন তখন রাস্তায় কানধরে উঠবস করাবে তবু পাবলিকের প্রীতি দূর হয়না। মুখে কিছু বলিনা। খামোখা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আর দিনকাল আসলেই খুব সুবিধার না।

ট্রেনের গতি কমে আসছে। প্লাটফর্মে ঢুকতে আর খুব দেরী নেই। ভদ্রলোক কোমর উঠানো শুরু করেছেন। এবার তার ব্যাগ গোছানো শুরু করবেন নিশ্চিত। ট্রেন থামার আগেই দরজায় গিয়ে ভীড় জমাবেন, সেটা ও নিশ্চিত প্রায়। মনে মনে আরেক প্রস্ত গালি দেই।
-'তা বাবাজী এসে গেলাম প্রায়। অনেক কথা বললাম । কিছু মনে করেননি তো। আমারো একটা ছেলে আছে । আপনার বয়সীই হবে। না , আপনার চেয়ে আরেকটু বড়ো'
অর্থহীন কথা। আমি আতংকিত হই। নতুন কোন গল্প শুরু হয় বোঝি।
-'তবে আমার ছেলেটা আপনার মতো নয়'
-আমার মতো নয়, মানে?

নিজের অজান্তেই এই প্রথম আমি তার কথার জবাব দেই।
-আমার ছেলেটা পংগু। একটা মাত্র ছেলেই আমার সর্বনাশ। লোকটা এখন পংগু ছেলের গল্প ফেঁদে সাহায্য না চাইলেই হয়। পোষাক আষাকে ভদ্রলোক যদি ও। বিশ্বাস কি? যা দিনকাল পড়েছে। আমার আর কথা না বাড়ানোই নিরাপদ।

তবু কি আশ্চর্য! আমিই পালটা প্রশ্ন করি। আমার কন্ঠ কি কিছুটা আর্দ্র?
-দুঃখিত। কি হয়েছিলো ওনার? কোন অসুখ,কোন দুর্ঘটনা?
-দুর্ঘটনা? হ্যাঁ। তা দুর্ঘটনা ও বলতে পারেন কি এক অদ্ভুত কারনে আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে এই বৃদ্ধের পংগু ছেলেটার কথা জানতে।
-বলুন না প্লিজ? কি হয়েছিলো?
-১৯৯০। মনে আছে বাবাজী? বয়স কতো তখন? ১০/১২? আমার ছেলেটা তখন ১৮। কলেজে পড়ে। আন্দোলন করে। আর্মি পিটিয়ে ওর কোমরের হাড় আর দুপা ভেংগে দিয়েছিলো। বুট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছিলো ওর পুরুষাংগ'

আমি বেদনার্ত হই। অন্ততঃ হওয়া উচি। একজন বাবার মুখ ঝুলে পড়েছে তার একমাত্র পুত্রের পংগুত্বের গল্প বলতে গিয়ে।

কিন্তু আমি বেদনার্ত হইনা। এই বকবকে বুড়ো একটু আগেই বলছিলেন এই দেশে যেনো আরো ২০ বছর সেনা শাসন থাকে। এই বুড়োকে আমি মনে মনে গালি দিয়েছিলাম 'মর্ষ্কামী ভোদাই' বলে। আমার এবার তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালি দিতে ইচ্ছে করে।
-আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনিই আগে বললেন অন্ততঃ আরো ২০ বছর সেনাশাসন দরকার। অথচ আপনার ছেলে ওদের হাতেই। আসলে আপনাদের মতো মানুষদের জন্যই...'

ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকছে এবার। গতি প্রায় থেমে এসেছে। বৃদ্ধ তার ব্যাগ গুছিয়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন। ফিরলেন। ফিরে এলেন আমার কাছে। আমার চোখে চোখ রাখলেন। কেমন ঘোলাটে। গা শিউরে উঠে। গলা নামালেন। হিসসিস করে বললেন-

২০ নয়, ২০০ বছর ধরে আমি আর্মির শাসন চাই। প্রত্যেক মা-বাবার একটা করে ছেলে গুলী খেয়ে মরুক নয়তো পংগু হয়ে পড়ে থাক বিছানায়, আমার ছেলের মতো।

বাইরে চমৎকার রোদ। তবু কেনো জানি সহসা তীব্র শীতের কাঁপুনি আমার সমস্ত জুড়ে। গন্তব্য পৌঁছে গেছি। উঠা দরকার। উঠতে পারছিনা। পারছিই না আর।

4 comments for "তক্ষক (লেখকঃ হাসান মোরশেদ)"
মোঃ হামিদ
delete

এডমিনকে বলছি, আপনাদের সাইটের জন্য এডসেন্স আবেদন করুন। হইলেও হইতে পারে। আরো গল্প চাই।

হামিদ ভাই, আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এডসেন্স এর জন্য আবেদন করেছিলাম কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য হলো না। আর, আরো গল্প পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।

Amio golpo likte chai....blog e likte gele kivabe korte hobe.amr dairi te onek golpo lekha ace.