ভুতের সাথে

Be the first to comment!

“হরিপ্রসাদের বাড়ি যাব, বলতে পারেন কোথায় ?”
লোকটাকে প্রশ্ন করা বোধ হয় আমার উচিত হয়নি। আমার চেহারার দিকে অপলক দৃস্টি তার, মনে হচ্ছে চোখের মনি দপদপ করে জ্বলছে। যেন আমার ভাষা কোন ভিনগ্রহের এলিয়েনের ভাষা, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। আমি আবার জিজ্ঞেস
করলাম সেই একই প্রশ্ন “হরিপ্রসাদের বাড়ি যাব, রাস্তাটি কি এই দিকে? নাকি ঐদিকে?” আমি অংগুলি নির্দেশ করলাম। শেষ ট্রেনটি স্টেশন থেকে ছেড়ে চলে গেল। এখন চারদিকে শুনশান নীরবতা । গাছের পাতা পরার শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, চারদিক অন্ধকার অমাবস্যায় ঢেকে গেছে। বিদ্যুৎ নেই, কিছুক্ষণ আগেও দুজন গার্ড ছিল, এখন আর দেখা যাচ্ছে না, তারাও চলে গেছে কোথাও। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে কিছুটা ভয় ও সংশয় দেখা দিল, লোকটা কি তাহলে বোবা, নাকি কানে খাটো, নাকি পাগল। হবে হয়ত কোন একটা, না হলে কথার উত্তর দিচ্ছে না কেন, ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে
আছে আমার দিকে। কিছুক্ষণ পর আমাকে প্রায় অবাক করে দিয়ে লোকটা উত্তর দিল, “হরিপ্রসাদকে আপনার কি দরকার?”
: আছে, দরকার না হলে কি এখানে আসা। তা আপনি কি ওনার কাছে একটু নিয়ে যেতে পারবেন ?
: পারব বৈকি, অবশ্যই পারবো, অবশ্যই পারবো।
এই বলে লোকটা দাড়িয়ে বলল ঐ যে দেখছেন পাকুড় গাছটা, ঐখানের সবচাইতে বড় ডালটায় উনি থাকেন। তবে আমি কিন্তু কাছে যেতে পারব না। লোকটার শরীর থেকে গাঁজার উৎকট গন্ধ আসছিল । নেশার ঘোরে আবোল তাবোল
বকছে বোধ হয় । নিরর্থক দাড়িয়ে থাকার
কোনো মানে হয় না । আমাকে ভুলে গেলে
চলবে না আমি একজন সাংবাদিক । অদ্ভুত ফিচারের জন্যই এ শ্যামপুর গ্রামে আসা । কিন্তু চারদিকের নীস্তব্ধতা ও ভুতুরে পরিবেশ সে আশাকে নিরাশা করবে তা হতে দেয়া যায় না । ভয়ের কাছে হার মানবো সে রকম ছেলে আমি নই । অনেক সাহস করে অন্ধকার রাস্তা ধরে হাটা শুরু করলাম। রাস্তার দুধারে ঝোঁপঝাড়ে ছেয়ে গেছে । দুপাশে ঘন জঙ্গল, আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে । জোনাকিরা শুধু মিটিমিটি জ্বলছে । আমি নিঃশব্দে হাটার চেষ্টা করলাম কিন্তু পায়ের নীচে খড়খড়ে শুকনো পাতার কচকচ শব্দ হতে লাগল ।
ক্রমেই মনের গহীনে ভয় দানা বেঁধে উঠল ।
ঝিঁঝিঁ পোকা থেমে থেমে ডেকে যাচ্ছে
কানের কাছে ঝাঁ ঝাঁ শব্দ হচ্ছে । ভয়ে পা দুটি
চলছে না, মনে হচ্ছে হাজারো মন পাথর বেঁধে
রাখা হয়েছে পায়ে । হঠাৎ সম্পূর্ণ নীস্তব্ধতা
ভেঙে, কে যেন ডাকল, “কে?, কে ওখানে?
কে যাচ্ছে? ” , আমি নিজেকে সামলে নেয়ার
চেষ্টা করে বললাম, “জ্বি, আমি ঢাকার ‘সূর্যের দিন পত্রিকা’ অফিস থেকে এসেছি, আমি একজন সাংবাদিক”, ভয়ে আমার বুক কাঁপছে । কাছে আসতে আসতে লোকটা বলল “বাবা তুমি এতরাতে একা একা কি করছো? আমি এখানকার চৌকিদার, কোথায় যাবে বল,
আমি পৌঁছে দিয়ে আসি, যদি কিছু মনে না কর তাহলে আজ রাতটা আমার বাসায় থাকতে পারো । আমি অবশ্য একা মানুষ, তোমার ভয় লাগতে পারে ।” লোকটার কথায় আমার আত্মসম্মানে ঘা লাগল, আমি বললাম, “জ্বি
আমি থাকতে পারবো আমার ভয় লাগবে না আর কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব, আপনাকে দেখে মনে অনেকটা সাহস পাচ্ছি ।”
লোকটা পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল ।
অদ্ভুত তার হাটার ভঙ্গি । মনে হচ্ছে ক্রমশই সে
মাটি থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে, আবার মাটিতে
নামছে । হাটতে হাটতে লোকটা প্রশ্ন করল,
“আপনি যেন কোন পত্রিকা থেকে এসেছেন
বললেন?”
: জ্বি আমি ত্রৈমাসিক পত্রিকা “সূর্যের দিন” থেকে
এসেছি । নতুন পত্রিকা তো আপনি বোধ হয়
চিনবেন না ।
:না না, চেনাইতো লাগছে । তা কি জন্য এসেছেন
যেন? আমি আবার কোন কিছু মনে রাখতে পারি না ।
:অদ্ভুত কোন ফিচারের জন্য । আপনার কি মনে
হয়, আমি এখানে কোন অদ্ভুত জিনিস খুঁজে
পাবো?
:অদ্ভুত কোন জিনিস মানে অলৌকিক কিছু ?
: হ্যাঁ অবাস্তব কিছু, যা সাধারণত ঘটে না ।
: কি জানি পাবেন হয়তো । তবে আমার তাতে মাথা ব্যথা নেই । সারারাত পাহারা দেয়াই আমার কাজ । অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই না ।
কথা বলতে বলতে চৌকিদার লোকটা ঝোপঝাড়
ছেড়ে ঘন জঙ্গলের দিকে যেতে লাগলেন ।
অন্ধকারে তাকে অনুসরণ করতে কষ্ট হচ্ছিল।
গহীন জঙ্গলের মাটি কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতে থাকে ।
আমার পা কাঁদায় পুরো মাখামাখি অবস্থা । হাটতে বেগ পেতে হচ্ছে , কিন্তু চৌ্কিদার লোকটা দিব্যি হেটে সামনে চলে যাচ্ছে, কোন প্রকার সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয় না । অনেক দূর হাটার পর বিশাল এক বটগাছের সামনে চলে এল সে, আমাকে বলল, “এটাই আমার বাড়ি”।, আমি কোথাও কোন ঘরবাড়ির চিহ্ন দেখতে পেলাম না । তারপর সে বলল, “চলুন আমার বাড়িতে” এ পর্যায়ে লোকটার আকার ক্রমশই বড় হতে লাগল, এক পর্যায়ে সে আমার বাঁ হাতটা শক্ত করে ধরে হ্যাচকা টানে একেবারে গাছের মগডালে নিয়ে গেল । আমার পায়ের নীচে এক ধরনের শীতল স্রোত বয়ে গেল । লোকটার চোখগুলো ঝুলে পড়েছে, দাঁত গুলো ক্রমশই বড় হচ্ছে, জ্বিভ দিয়ে টসটস জল পড়ছে, আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে লোকটা আসলে ভুত । আমি প্রানপন চেষ্টা করছি বাঁ হতটা ছাড়ানোর জন্য । ক্রমশই লোকটার জ্বিভ বড় হতে লাগল এবং এক সময়ে তার জিভ দিয়ে আমাকে পেঁচিয়ে ফেলল । বিশাল মুখে
পুরে ফেলার মত অবস্থা যখন, ঠিক তখনই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল । আমি অনেক কষ্টে পকেটে হাত ঢোকালাম, যদি কিছু পাওয়া যায় তাহলে অন্তত শেষ চেষ্টা করা যাবে । পকেট হাতরে আমার শখের একটি কলম পাওয়া গেল । কলমটা আমাকে একজন গিফট্ দিয়েছিল । আটশাট অবস্থায় কলমটার ক্যাপ পকেটেই ছিল । আমি কলমের সুচাঁলো দিকটা দিয়ে দ্রুত লোকটার মানে ভুতটার বাঁ চোখে একটা ঘা বসিয়ে দিলাম, আর অমনি সে আমাকে ছেড়ে দিল, আমি নীচে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম । জ্ঞান ফেরার পর দেখি, আমি শ্যামপুর সরকারী হাসপতালে । ডাক্তার আমাকে বললেন সুরুজ নামে এক গ্রামবাসী আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, সে বাইরে অপেক্ষা করছে । সুরুজ ও গ্রামবাসীদের ধারনা আমাকে ভুতে ধরে ছিল আর সে ভুত টা হচ্ছে এ গ্রামের মৃত এক চৌকিদার এর আত্মা, যে এখনো সবাইকে ভয়
দেখায়, ভুত হিসেবে সবার কাছে আবির্ভুত হয় ।
কিন্তু ডাক্তার এর ধারনা আমি বিশেষত ভয় পেয়ে হ্যালুসিনেশন বা ইলুশন এ আক্রান্ত হয়েছিলাম ।
একদিকে ডাক্তার অন্যদিকে গ্রামের সব মানুষ, কার কথা বিশ্বাস করবো বুঝতে পারছি না । গ্রামের এতগুলো মানুষের তো আর একসাথে
হ্যালুসিনেশন হতে পারে না । তাই দেরী না করে
বাইরে বের হয়ে এলাম, দেখলাম যে লোকটা রাতে ট্রেন প্লাটফর্ম এ বসে ঝিমুচ্ছিলো সেই
লোকটাই আসলে সুরুজ । তাকে ধন্যবাদ দিলাম আর বেশি কিছু বললাম না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম ঢাকা যাওয়ার ট্রেন কয়টায়, তারপর সে দিনই ঢাকার ট্রেনে বাড়িতে এসে পড়ি । এরপর অনেক দিন আর পত্রিকা অফিসে যাওয়া হয়নি। কিন্তু বিষয়টা এখনও আমার কাছে পরিষ্কার নয়, আসলেই কি হ্যালুসিনেশন ছিল নাকি সত্যিকারের ভুত ??…………………

0 comments for "ভুতের সাথে"